রমজানে ইবাদত করার সময় মেলাবেন কীভাবে
রমজানে ইবাদত করার সময় মেলাবেন কীভাবে
০৫ এপ্রিল বুধবার, ২০২৩
পবিত্র রমজান পুণ্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাস। মহান প্রভুর দরবারে ইবাদত ও আনুগত্যের নজরানা পেশ করার সেরা সময়। পাপমুক্ত জীবন গঠন ও গুনাহবিরুদ্ধ চেতনা ধারণ করার সময় এ মাস। আল্লাহর অফুরন্ত কৃপা ও অনুগ্রহে সিক্ত হয়ে কুপ্রবৃত্তি ও গুনাহমুখী কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসার মাস এটি।
রাসুল (সা.) সমস্ত মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। যাপিত জীবনের মুহূর্তগুলো কীভাবে ইবাদতে পরিণত করতে হয়—তার উত্তম উদাহরণ তিনি উম্মতের সামনে সৃষ্টি করে গেছেন। রমজানের পবিত্র সময় ও ঈমানি মুহূর্ত সর্বদা পাওয়া যায় না। রমজানের মহাফজিলতপূর্ণ সময়ে সঠিকভাবে ইবাদতে ব্যয় করে আল্লাহর প্রীতিভাজন হতে পারলে, পরকালে দুর্ভাগা হওয়ার আশংকা শূন্য। প্রতিটি রমজানকে জীবনের শেষ রমজান মনে করেই অতিবাহিত করা উচিত। নবী করিম (সা.) ছোট ছোট মুহূর্ত ও সামান্য ক্ষণকেও ইবাদতে রূপান্তর করতেন। পরিকল্পনা করে আমলনামায় সওয়াব বৃদ্ধির চেষ্টা করতেন। জীবনের সামান্য মুহূর্তও সওয়াব অর্জনবিহীন অতিবাহিত হতে দিতেন না। রাসুল (সা.)-এর জীবনেতিহাস এ ধরণের ঘটনায় ভরপুর।
রমজানের শেষরাতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সংক্ষিপ্ত এই সময়ের ভেতরেই নবী (সা.) অনেকগুলো ইবাদত করতেন। শেষরাতে নবী (সা.) তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) রাতে দীর্ঘ সময় তাহাজ্জুদ আদায় করতেন, তার পবিত্র পা ফুলে যেতো।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৮২০)
সেহরি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। রাসুল (সা.) সেহরি করতেন সময়ের শেষের দিকে। হাদিসে আছে, ‘তোমরা সেহরি করো, সেহরিতে বরকত আছে।’ (বোখারি, হাদিস: ১৯২৩)
কখনও কখনও নবী (সা.) মেহমানকে সাথে নিয়ে সেহরি করতেন। মেহমানের সাথে আহার করাও একটি ইবাদত। আনাস (রা.) বলেন, ‘একদিন সেহরির সময় নবী করিম (সা.) বললেন, আনাস! রোজার নিয়ত করেছি। খাবারের ব্যবস্থা করো। আমি খেজুর-পানি উপস্থাপন করলাম। তিনি আবার বললেন, দেখো তো, আমার সাথে সেহরিকরার মতো কাউকে পাও কিনা? আমি জায়েদ ইবনে হারেসাকে ডেকে আনলাম। তিনি রাসুল (সা.)-এর সাথে সেহরি করলেন।’ (নাসায়ি, হাদিস: ২১৬৬) নবী (সা.) রমজানের শেষরাতে খুব গুরুত্ব সহকারে দোয়া-কান্নাকাটি করতেন। দোয়াও একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। হাদিসে আছে, ‘আল্লাহ তাআলা প্রতিদিন শেষরাতে দুনিয়ার আসমানে নেমে এসে ঘোষণা করতে থাকেন, এখন দোয়া করলে কবুল করবো। চাইলে দান করবো। ক্ষমা প্রার্থনা করলে মাফ করে দেবো।’ (মুসলিম, হাদিস: ৭৫৮)
বর্ণিত হাদিসগুলো থেকে আমরা জানতে পারলাম, রাসুল (সা.) শেষরাতের সংক্ষিপ্ত সময়ে অনেকগুলো ইবাদতের সুযোগ বের করে নিতেন।
বিকাল থেকে মাগরিব পর্যন্ত স্বল্প সময়। রোজার দিনে বিকালে রোজাদাররা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অনর্থক গল্প-আলাপ বা অলসতায় ব্যয় করে ফেলেন। অথচ নবী (সা.) ছোট-ছোট আমলের মাধ্যমে এ সময়কে ইবাদতে পরিণত করতেন। ইবাদতের প্রস্তুতির নিয়তে বিশ্রাম নিলে, বিশ্রামের সময়টুকুও ইবাদতে পরিণত হবে। নবী (সা.) জোহর থেকে আসরের পূর্বে বিশ্রাম গ্রহণ করতেন।
নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমার উপর তোমার শরীরের হক রয়েছে।’ (বোখারি, হাদিস: ১৯১৮) আসরের পর নবী (সা.) পরিবারকে সময় দিতেন। পরিবারকে সময় দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) পারিবারিক কাজে স্ত্রীদেরকে সাহায্য করতেন।’ (বোখারি, হাদিস: ৬৭৬)
অবস্থানভেদে বিভিন্ন মসজিদে রমজানে ইফতারির পূর্বে ধর্মীয় আলোচনা হয়। এসব আলোচনায় অংশগ্রহণ করে সময়টুকু ইবাদতে পরিণত করা যায়। নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় কল্যাণকর বিষয় (শরিয়ত) শেখার জন্য মসজিদে গমন করে, সে একটি হজের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে।’ (তবারানি, হাদিস: ৭৪৭৩)
সময়কে ইবাদতে পরিণত করার একটি উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হলো সর্বদা জিকির করা। এমনকি পেশাদার দায়িত্ব পালনকালেও জিকির করা কঠিন কিছু নয়। অভ্যাসের ব্যাপার মাত্র। নবী (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন মানুষ দুনিয়াতে থাকাবস্থায় জিকির না করা সময়ের জন্য আফসোস করবে।’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস: ৫১২)
পরিবারের সদস্যদের আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা, পাপাচারে বাধা প্রদান করা এমন একটি ইবাদত, যার জন্য পৃথকভাবে সময় বের করার প্রয়োজন হয় না। অথচ এটা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মাহে রমজানে শরিয়তের বিধান পালনের প্রশ্নে পরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধান করার আবশ্যকতা অনেক বেশি। বিশেষ করে পরিবারের উঠতি বয়সের সদস্যরা ঠিকমত রোজা পালন করছে কিনা, নামাজ আদায় করছে কিনা, তারাবি আদায় করছে কিনা, এসবের খোঁজ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। পরিবারের সাথে কাটানো সময়ের ভেতরেই এই ইবাদতের সুবর্ণ সুযোগ লাভ হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা করো সেই আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৬)
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) রমজান মাসে ইবাদতের জন্য পরিবারের সদস্যদেরকে জাগ্রত করে দিতেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ১১৭৪)
কর্মক্ষেত্র-অফিসে গমনের পূর্বে আমরা সাধারণত পরিচ্ছন্ন-পবিত্র হয়েই বের হয়। এ সময় একটু সতর্ক হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা যায়। ফলে সময়টি যেমন ইবাদতে পরিণত হবে, তেমনি নামাজের বদৌলতে বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব হবে।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্বে দুই রাকাত নফল আদায় করে নাও। নামাজ তোমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে।’ (মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস: ৮৫৬৭)
উল্লিখিত আয়াত-হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়, পরিকল্পনা ও পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করলে পবিত্র রমজানের সময়গুলো ইবাদতে পরিণত করা সম্ভব। নবী (সা.) বলেছেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের হিসেব না দিয়ে কারও পক্ষে কেয়ামতের দিন সামনে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৪১৫) জীবনের কোনও মুহূর্ত সওয়াব অর্জন ব্যতীত অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার চেয়ে লজ্জার আর কোনও বিষয় নেই। সুতরাং নবী জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে রমজানের সময়গুলো ইবাদতে পরিণত করার চেষ্টা করা উত্তম।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url