OrdinaryITPostAd

যুগে যুগে আল্লাহর পথে নবী রাসুলদের দাওয়াত

 

যুগে যুগে আল্লাহর পথে নবী রাসুলদের দাওয়াত

২৯শে মার্চ বুধবার ২০২৩



الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا. قَيِّمًا لِيُنْذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا مِنْ لَدُنْهُ وَيُبَشِّرَ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًا. مَاكِثِينَ فِيهِ أَبَدًا. (سورة الكهف :1-3)

وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، أَمَّا بَعْدُ:


প্রিয় মুসল্লিয়ান! আজ আমি আপনাদের সামনে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। আর তা হলো দাওয়াত ও তাবলীগে দীনের মহান দায়িত্ব যা আম্বিয়ায়ে কিরামের ওপর অর্পিত অভিন্ন দায়িত্ব বলে বিবেচিত। দাওয়াত-প্রচারের মহান দায়িত্ব নিয়েইআম্বিয়ায়ে কিরাম প্রেরিত হয়েছেন যুগে যুগে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির কাছে।


আল্লাহর প্রতি যাদের বিশ্বাস নেই, অথবা থাকলেও শিরক-মিশ্রিত, অথবা বিকৃত তাদের সঠিক পথের দিশা দেয়া, দাসত্বের সরল সঠিক পথ তাদের সামনে পরিষ্কারভাবে উম্মোচিত করে তাদেরকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাতে কিয়ামতের ময়দানে বলতে না পারে, আমাদের কাছে জান্নাতের সুসংবাদদাতা অথবা জাহান্নাম থেকে হুঁশিয়ারকারী হিসেবে কেউ আসেনি। ইরশাদ হয়েছে :


{أَنْ تَقُولُوا مَا جَاءَنَا مِنْ بَشِيرٍ وَلَا نَذِيرٍ فَقَدْ جَاءَكُمْ بَشِيرٌ وَنَذِيرٌ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِير}


'যেন তোমরা না বল যে, আমাদের নিকট কোনো সুসংবাদদাত কিংবা সতর্ককারী আসেনি। অবশ্যই তোমাদের নিকট সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এসেছে। আর আল্লাহ সব কিছুর ওপর মতাবান’ (সূরা আল মায়িদা:১৯)


প্রিয় মুসল্লিয়ান! আল্লাহ তাআলা মানুষকে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। আর তা হলো একমাত্র আল্লাহ তাআলার একক সত্তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে কেবল তাঁরই ইবাদত করা। ইবাদত-বন্দেগী, দুআ-প্রার্থনার ক্ষেত্রে অন্য কাউকে তাঁর সাথে শরীক না করা। ইরশাদ হয়েছে :


{وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ، مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ.}


আর জিন ও মানুষকে আমি কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে। আমি তাদের কাছে কোন রিযক চাই না আর আমি চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিবে (সূরা আয্যারিয়াত: ৫৬-৫৭)


আর আল্লাহ তাআলা অসীম দয়ালু,করুণার আধার। তাই তিনি মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য,পৃথিবীতে মানুষের করণীয়, মানুষের সর্বশেষ গন্তব্য ইত্যাদি বিষয় সবিস্তারে বাতলে দেয়ার দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়েছেন এবং নবী রাসূলগণের মাধ্যমে তার সুস্পষ্ট বিবরণ মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। কারণ মানুষ নিজ উদ্যোগে এসব বিষয়ের আদ্যোপান্ত জানতে অম।


আর এসব বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অর্জিত না হলে মানুষ তার কর্তব্য নির্ধারণে ব্যর্থহবে নিশ্চিত রূপেই। ফলে পরকালের শাশ্বত জীবনে বঞ্চিত হবে অফুরান নিয়ামতপূর্ণ জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবে রাব্বুল আলামীনের মহা-আনন্দময় দীদার থেকে। শুধু তাই নয় বরং তার আবাস হিসেবে নির্ধারিত হবে মর্মন্তুদ শাস্তি ও অসহনীয় কষ্ট-যাতনার ভয়াবহ স্থান জাহান্নাম।


তাই নবী রাসূলগণের মৌলিক দায়িত্ব ছিল মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করা, চিরন্তন সত্যের পথে আহ্বান করা, মানুষ যেসব সত্য নিজ থেকে আবিষ্কার করতে অম সেসব বিষয়ে তাকে অবহিত করা।


আর যারা তাদের দাওয়াত গ্রহণ করবে তাদেরকে পরকালীন শাশ্বত সুখের সুসংবাদ দেয়া এবং যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে তাদেরকে জাহান্নামীজীবনের দুঃসংবাদ পৌঁছে দেয়া, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে হুঁশিয়ার করা। ইরশাদ হয়েছে :

{إِنَّا أَخْلَصْنَاهُمْ بِخَالِصَةٍ ذِكْرَى الدَّارِ.}


‘নিশ্চয় আমি তাদেরকে বিশেষ করে পরকালের স্মরণের জন্য নির্বাচিত করেছিলাম’ (সূরা সাদ:৪৬)


প্রিয় ভাইয়েরা! নবী-রাসূলগণ মানুষকে জাহান্নামী জীবন থেকে উদ্ধার করে জান্নাতের পথে নিয়ে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।


আল্লাহর প থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অকান্ত পরিশ্রম করে, সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। নবী-রাসূলগণ যেসব জাতি ও মানব সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন তাদেরকে পয়গামে ইলাহী পৌঁছিয়ে পৌঁছিয়ে বালাগুল মুবীনের পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে গেছেন এবং তাদের ওপর আল্লাহর প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন।


অর্থাৎ তাদেরকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, তাদের কেউ আর বলতে পারবে না, আমাদের কাছে চিরসুখের জান্নাতী জীবনের পথ দেখানোর জন্য কেউ আসেনি। জান্নাতের সুসংবাদবাহক কেউ প্রেরিত হয়নি। অথবা মর্মন্তুদ শাস্তির ঠিকানা জাহান্নাম থেকে হুঁশিয়ারকারী কেউ আসেনি। ইরশাদ হয়েছে :


{رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا}


‘আর (আমি পাঠিয়েছি) রাসূলগণকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহর বিপে রাসূলদের পর মানুষের জন্য কোন অজুহাত না থাকে। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আন- নিসা:১৬৫)।


আখেরী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের মাধ্যমে নবী-রাসূল প্রেরণের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আর কেউ নবী হিসেবে প্রেরিত হয়ে মানুষের কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছাতে আসবেন না।


তবে যেহেতু পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মানব সম্প্রদায়ের বংশ বিস্তার অব্যাহত থাকবে, তাই যারা ঈমানহারা, যারা সত্যের পথ থেকে দূরে অবস্থান করে, তাদের কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দেয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি।

তাদেরকে ঐশী আদর্শ ও মূল্যবোধ তথা ইসলামের প্রতি আহ্বানের দায়িত্ব রহিত হয়ে যায় নি, বরং খতমে নবুওতের পর তাবলীগে দীনের এ মহান দায়িত্ব উম্মতে মুহাম্মাদীর কাঁধে অর্পিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে :


{قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ}


‘বল, ‘এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (সূরা ইউসুফ: ১০৮)।


তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারী হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তিকেই যার যার সাধ্য অনুযায়ী ইসলামের প্রচারমূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকতে হবে। অন্যথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারী হওয়ার দাবি মিথ্যা বলে সাব্যস্ত হবে।


প্রিয় মুসল্লিয়ান! দাওয়াত তথা ইসলামের প্রচার প্রসারে আমাদেরকে ঐকান্তিকভাবে কাজ করে যেতে হবে। এ পথে জান-মাল ব্যয় করতে হবে। কেবল নিজে সত্যানুসারী হলে দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না বরং অন্যদেরকেও সত্যের দিকে আহ্বান করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার দাবি ও চাহিদা সামনে রেখে কর্তব্য পালনে মনোযোগী হতে হবে। গুরুত্বানুসারে


দাওয়াতী কার্যক্রমের টার্গেটসমূহ ঢেলে সাজাতে হবে। যারা তাওহীদে অবিশ্বাসী, আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্ববাদে যাদের ঈমান নেই তাদের প্রতি দাওয়াতী কার্যক্রমের প্রারম্ভিক বিন্দু হবে তাওহীদের প্রতি বিশ্বাসের আহ্বান। তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপিত হলে নামাযের প্রতি আহ্বান। এরপর রোযা , হজ্ব, যাকাত ইত্যাদির প্রতি পর্যায়ক্রমে আহ্বান। ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে

বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে:


(قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِمُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ حِينَ بَعَثَهُ إِلَى الْيَمَنِ إِنَّكَ سَتَأْتِي قَوْمًا أَهْلَ كِتَابٍ فَإِذَا جِئْتَهُمْ فَادْعُهُمْ إِلَى أَنْ يَشْهَدُوا أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذَلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذَلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذَلِكَ، فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ)


‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম মুআ‘য ইবনে জাবাল রাযি. কে যখন ইয়েমেনে পাঠান, তখন তাকে বলেন, ‘তুমি নিশ্চয় কিতাবীদের কাছে যাবে। তাই যখন তুমি তাদের কাছে যাবে, তাদেরকে এ কথার প্রতি স্যা দানের আহ্বান জানাবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল।


অতঃপর তারা যদি এ বিষয়ে তোমার আনুগত্য করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যদি তারা এ বিষয়ে তোমার আনুগত্য করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর যাকাত

ফরয করেছেন, যা ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে দরিদ্রদেরকে দেয়া হবে। যদি তারা এব্যাপারে তোমার অনুসরণ করে তবে তুমি তাদের সর্বোত্তম সম্পদ পরিহার করবে। আর মাযলুমের দু‘আ থেকে হুঁশিয়ার থাকবে কেননা মাযলুম ব্যক্তি ও আল্লাহর মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই’ (বুখারী)


আবূ হুরায়রা রাযি. হতে এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো, ‘ উত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হলো, ‘এরপর কোনটি ? ’তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ (জান মাল ব্যয়) করা’। বলা হলো, ‘এরপর কোনটি? তিনি বললেন,‘মাবরুর হজ্ব’ (বুখারী)।


মুহতারাম মুসল্লিয়ান! দাওয়াতের স্থান-কাল ও পাত্র নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ও আমাদেরকে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে দাওয়াতী বিষয়বস্তু


 উপস্থাপনের পন্থা ও পদ্ধতি নির্ণয় করতে হবে। যার সাথে যেভাবে কথা বললে অধিক ফলপ্রসু বলে মনে হবে তার সাথে সে ধরনের ভাষায় কথা বলতে হবে। এ দিকে ইঙ্গিত করেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে :


{وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ.}


‘আর আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার কাওমের ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়, সুতরাং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা ইবরাহীম: ৪)


কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে দাওয়াত দিতে গেলে তাকে যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে। অন্যথায় মানসিকভাবে সে দাওয়াতী কথাবার্তা শোনার জন্য অপ্রস্তুত থাকবে। এ কারণেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন


(:إِذَا أَتَاكُمْ كَرِيْمُ قَوْمٍ فَأَكْرِمُوهُ‘)


তোমাদের কাছে কোনো সম্প্রদায়ের সম্মানিত ব্যক্তি এলে তাকে সম্মান কর’ (ইবনে মাজাহ)।


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সম্রাট হেরাকল-এর কাছে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত পাঠান তখন তিনি তাকে ‘আযীমুর রুম’ অর্থাৎ রোমের মহান ব্যক্তি বলে খেতাব করেছিলেন। তাই সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখিয়েই দাওয়াতকর্ম শুরু করতে হবে।

আর যারা দুর্বল তাদের প্রতিও যতœশীল হতে হবে। কারণ এরাই হলো দাওয়াতের মূল শক্তি। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে

দুর্বলরাই দাওয়াত গ্রহণে অধিক আগ্রহী হয়ে থাকে। দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বলদের তুলনায় দুর্বলরাই অধিক হারে এগিয়ে আসে।

সম্মানিত মুসল্লিয়ান! দাওয়াত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরী।


পুরো ইসলাম একসাথে উপস্থাপন করার পরিবর্তে প্রথমে আকীদা-বিশ্বাস দিয়ে শুরু করা। এরপর পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আল্লাহর প্রতি ঈমান, রাসূলের প্রতি ঈমান, আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান, আখিরাতের প্রতি ঈমান, ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান ইত্যাদি বিষয় সর্বাগ্রে উপস্থাপন করা। অর্থাৎ ঈমান ও আকীদাসংক্রান্ত বিষয়গুলো আগে উপস্থাপন করা।


এসবের প্রতি যখন ব্যক্তির ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং যথার্থভাবে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে নেবে, তখন পর্যায়ক্রমে তাকে আমলী বিষয়গুলোর প্রতি দাওয়াত দেয়া, যেমন নামায রোযা হজ্ব যাকাত ইত্যাদি। দাওয়াতী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী। আয়েশা রাযি. থেকে এক বর্ণনায় এসেছে:


(وَلَوْ نَزَلَ أَوَّلُ شَيْءٍ : لَا تَشْرَبُوْا الْخَمْرَ ، لَقَالُوْا : لَا نَدَعُ الْخَمْرَ أَبَداً، وَلَوْ نَزَلَ : لَا تَزْنُوْا، لَقَالُوْا: لَا نَدَعُ الزِّنَا أَبَداً، لَقَدْ نَزَلَ بِمَكَّةَ عَلَى مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَإِنِّيْ لَجَارِيَةٌ أَلْعَبُ : { بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَالسَّاعَةُ أَدْهَى وَأَمَرُّ } . وَمَا نَزَلَتْ سُوْرَةُ الْبَقَرَةِ وَالنِّسَاءِ إِلَّا وَأَنَا عِنْدَهُ.)


‘যদি শুরুতেই নাযিল হতো : তোমরা মদপান করো না, তবে তারা বলত,‘ আমরা কখনো মদ ছাড়ব না। যদি শুরুতেই নাযিল হতো: তোমরা যিনা করো না, তবে তারা অবশ্যই বলত: আমরা কখনো যিনা ছাড়ব না।


মক্কায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট নাযিল হয়েছে, ‘বরং কিয়ামত তাদের প্রতিশ্র“ত সময়। আর কিয়ামত অতি ভয়ঙ্কর ও তিক্ততর। আর তখন আমি ছিলাম ছোট বালিকা। আর সূরা বাকারা ও সূরা নিসা যখন নাযিল হলো তখন তো আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘর করছি’ (বুখারী)।


দাওয়াতকর্মে আদর্শিক দৃঢ়তা অত্যন্ত জরুরী । সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে এ আশঙ্কায় অনেকেই দাওয়াতী বিষয়বস্তু উপাস্থাপন থেকে বিরত থাকেন। এটা মারাত্মক অন্যায়। কেননা দাওয়াত অবশ্যই পৌঁছাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ত্র“টি বা উদাসীনতা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তাআলা এব্যাপারে সতর্ক করে বলেন :


{يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ.}


‘হে রাসূল, তোমার রবের প থেকে তোমার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে তা পৌঁছে দাও। আর যদি তুমি না কর তবে তুমি তাঁর রিসালাত পৌঁছালে না। আর আল্লাহ তোমাকে মানুষ থেকে রা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে হিদায়েত করেন না’ (সূরা আল মায়িদা:৬৭)

আম্বিয়ায়ে কেরাম সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। দাওয়াতকর্ম শুরু করার পূর্বে তারা সবাই নিজ নিজ কাওমের কাছে অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন।


কিন্তু দাওয়াতকর্ম শুরু করার সাথে তিনি তাদের বিরাগভাজন হয়ে যান। কিন্তু এ জন্য তাঁদের কেউ দাওয়াত কর্ম ছেড়ে দেননি। নবী সালেহ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে তাঁর কাওমের বক্তব্য হলো:


{قَالُوا يَا صَالِحُ قَدْ كُنْتَ فِينَا مَرْجُوًّا قَبْلَ هَذَا أَتَنْهَانَا أَنْ نَعْبُدَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا وَإِنَّنَا لَفِي شَكٍّ مِمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ مُرِيبٍ .}


‘তারা বলল, ‘হে সালিহ, তুমি তো ইতোপূর্বে আমাদের মধ্যে ছিলে প্রত্যাশিত। তুমি কি আমাদেরকে নিষেধ করছ তাদের উপাসনা করতে আমাদের পিতৃপুরুষরা যাদের উপাসনা করত? তুমি আমাদেরকে যার দিকে আহ্বান করছ, সে ব্যাপারে নিশ্চয় আমরা ঘোর সন্দেহের মধ্যে আছি’ (সূরা হূদ:৬২)


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াতকর্ম ছেড়ে দিলে অথবা কুরাইশদের ইচ্ছানুযায়ী তাতে পরিবর্তন ঘটালে তিনি আজীবন তাদের বন্ধু হয়ে থাকতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাও তাঁকে কঠিনভাবে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে :


{وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ وَإِذًا لَاتَّخَذُوكَ خَلِيلًا. وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا. إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا.}


আর তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, আমি তোমাকে যে ওহী দিয়েছি, তা থেকে তারা তোমাকে প্রায় ফিতনায় ফেলে দিয়েছিল, যাতে তুমি আমার নামে এর বিপরীত মিথ্যা রটাতে পার এবং তখন তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত।


আর আমি যদি তোমাকে অবিচল না রাখতাম, তবে অবশ্যই তুমি তাদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়তে। তখন আমি অবশ্যই তোমাকে আস্বাদন করাতাম জীবনের দ্বিগুণ ও মরণের দ্বিগুণ আযাব। তারপর তুমি তোমার জন্য আমার বিরুদ্ধে কোনো সাহায্যাকারী পাবে না’ (সূরা আল ইসরা:৭৩-৭৫)।


দাওয়াত প্রচারের ক্ষেত্রে শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশে ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব ইত্যাদির সম্পর্ক কাজে লাগানোও একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর


 দাওয়াতকর্মে সহযোগিতার জন্য তাঁর ভাই হারুন আলাইহিস সালামকে সঙ্গী করে নিয়েছিলেন।

দাওয়াত প্রচারে বিনম্র আচরণ ও কথা একটি জরুরী বিষয়। মূসা ও হারুন আলাইহিমাস সালামকে আল্লাহ তাআলা খেতাব করে বলেন :


{اذْهَبَا إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى. فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى.}


‘তোমরা দু’জন ফির‘আউনের নিকট যাও, কেননা সে তো সীমালংঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নরম কথা বলবে। হয়তোবা সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে’ (সূরা তাহা:৪৩-৪৪)


দাওয়াত প্রচারে অকাট্য দলীল প্রমান পেশ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা জরুরী । যাতে দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির সকল সন্দেহ দূরীভূত হয় এবং দাওয়াতকে অস্বীকার করার মতো তার কাছে কোনো প্রমাণ না থাকে। এ ক্ষেত্রে নমরুদের সাথে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কথোপকথন বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন


{:أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ . ‘}


তুমি কি সে ব্যক্তিকে দেখনি, যে ইবরাহীমের সাথে তার রবের ব্যাপারে বিতর্ক করেছে যে, আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছেন? যখন ইবরাহীম বলল, ‘আমার রব তিনিই’ যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান।

সে বলল, আমিই জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বলল, নিশ্চয় আল্লাহ পূর্বদিক থেকে সূর্য আনেন। অতএব তুমি তা পশ্চিম দিক থেকে আন। ফলে কাফির ব্যক্তি হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না’ (সূরা আল বাকারা:২৫৮)।


যাকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে তার বক্তব্য শোনা ও তাকে কথা বলতে দেয়াও একটি জরুরী বিষয়। দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার কথায় ও আচরণে কঠোর হলে


 দাওয়াতদাতাকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। দাওয়াত প্রচারে ধৈর্য হলো, নবী রাসূলগনের আদর্শ। দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির অসৎ আচরণে সকল নবী রাসূলের অভিন্ন বক্তব্য ছিল:


{وَمَا لَنَا أَلَّا نَتَوَكَّلَ عَلَى اللَّهِ وَقَدْ هَدَانَا سُبُلَنَا وَلَنَصْبِرَنَّ عَلَى مَا آَذَيْتُمُونَا وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ }


‘আর তোমরা আমাদের যে কষ্ট দিচ্ছ, আমরা তার ওপর অবশ্যই সবর করব। আর আল্লাহর ওপরই যেন তাওয়াক্কুলকারীরা তাওয়াক্কুল করে’ (সূরা ইবরাহীম: ১২)।


একজন দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে প্রয়োজনে বছরের পর বছর দাওয়াতী মেহনত চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও আমাদেরকে প্রত্যয়ী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। নূহ আলাইহিস সালাম সাড়ে নয়শত বছর পর্যন্ত তার কাওমের প্রতি দাওয়াতী মেহনত চালিয়ে গেছেন। রাতদিন, প্রকাশ্যে ও গোপনে সকল মাধ্যম ব্যবহার করে তাদেরকে তিনি দাওয়াত দিয়ে গেছেন। তাই এক্ষেত্রে ধৈর্যহারা হলে হক আদায় হবে না।


بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْمِ, أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور الرَّحِيْمْ .





এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪